বৃহস্পতিবার ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ - ০৯:৩৬
একা হাওজা এবং একা বিশ্ববিদ্যালয়—সমাজের চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়

হাওজা ও বিশ্ববিদ্যালয়—প্রতিটিই একা একা দেশের প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম নয়। এই দুইয়ের বিচ্ছিন্নতা ও মুখোমুখি অবস্থান সমাজকে নির্ভরশীলতা, পশ্চাৎপদতা ও পারস্পরিক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। পাহলভি শাসনামলের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে—ধর্মবিচ্ছিন্ন বিজ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানবিচ্ছিন্ন ধর্ম—উভয়ই সমাজকে সংকটে ফেলে। হাওজা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐক্য একটি জীবনঘনিষ্ঠ অপরিহার্যতা।

হাওজা নিউজ এজেন্সির প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাওজা ও বিশ্ববিদ্যালয় ঐক্য দিবস উপলক্ষে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ নেতার বক্তব্যের নির্বাচিত অংশ আপনাদের প্রাজ্ঞজনদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।

শুধু হাওজা—বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া—আজকের ইরানি জাতি ও দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। আবার শুধু বিশ্ববিদ্যালয়—হাওজা ছাড়া—তাও যথেষ্ট নয়। এখন যদি একদিকে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে, যার ভিত্তি গড়ে তোলা হয়েছে ধর্ম ও ইসলামী মূল্যবোধের বিরোধিতার ওপর—অর্থাৎ সেই মূল্যবোধের বিরোধিতায়, যেগুলোর বৈজ্ঞানিক রূপায়ণ হাওজাগুলো করতে চায়—এবং অন্যদিকে এমন একটি হাওজা গড়ে ওঠে, যা আধুনিক বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির বিরোধিতার ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকে; অথচ এই দুই ধারাই হওয়া উচিত একে অপরের সহায়ক ও পরিপূরক, ব্যবস্থার দুটি স্তম্ভ এবং মানবিক ও মহামানবিক উৎকর্ষে পৌঁছানোর জন্য দুটি ডানা—তখন যদি তারা একে অপরের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে, তাহলে পরিণতি কী হবে? ফল হবে সবচেয়ে ভয়াবহ। কারণ, দুটি শক্তি গঠনমূলক কাজে লাগার বদলে একে অপরকে ধ্বংস করার কাজে নিয়োজিত হবে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।

এটাই ছিল সেই পরিকল্পনা, যা পাহলভি নামক কলুষিত শাসনামলের মধ্যবর্তী বছরগুলোতে বাস্তবায়নের জন্য আঁকা হয়েছিল। প্রথমে তারা হাওজাকে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল। পরে বুঝল—এটা সম্ভব নয়। এই চিন্তাটি ছিল প্রথম দিককার। অর্থাৎ, শুরুর দিকে রেজা খান পাহলভি কুম শহরে হামলা চালিয়ে হাওজাকে বন্ধ করে দেয়। সেই সময় আমাদের মহান ইমাম, যিনি তখন এই সমাবেশের তরুণ তালেবাদের মতোই কুমে একজন তরুণ শিক্ষার্থী ছিলেন—হাওজার অবস্থা এমন ছিল যে, ইমাম নিজেই আমাদের বলতেন: দিনে আমরা কোমের গলি-রাস্তায় বের হওয়ার সাহস করতাম না। রেজা খানের পুলিশ পাগড়ি-পরা কোনো তালেবাকে রাস্তায় দেখা যেতে দিত না। ধরত, নির্যাতন করত, কারাগারে নিক্ষেপ করত, কাপড় খুলে নিত, অপমান করত, পাগড়ি ছিঁড়ে ফেলত; তারপর তাকে হয় জেলে, নয় নির্বাসনে, অথবা অনুরূপ কোথাও পাঠিয়ে দিত। এ রকম পরিস্থিতিতেই তালেবারা পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন।

তিনি বলতেন, আমরা দিনে কোমের আশপাশের বাগানে চলে যেতাম এবং গাছের নিচে, বাগানের পথঘাটে—রেজা খানের পুলিশের চোখের আড়ালে—পাঠ ও আলোচনা করতাম। রাতে অন্ধকার নামলে চুপিসারে কোনো কোণে, কোনো মাদরাসার কক্ষে গিয়ে রাত কাটাতাম। এভাবেই তারা শুরু করেছিল। কেন? কারণ তারা চাইত বিশ্ববিদ্যালয় থাকুক, কিন্তু হাওজা না থাকুক। রেজা খান সেই পথ বেছে নিয়েছিল। পরে বুঝল—এটা সম্ভব নয়। এই দেশে হাওজার শিকড় অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। যতই তালেবাদের দমন করা হোক, আলেম ও ধর্মীয় নেতারা দেশের নানা প্রান্তে গড়ে উঠছিলেন। এই জ্ঞানবৃক্ষকে তারা ধ্বংস করতে পারছিল না, কারণ এর সম্পর্ক ছিল মানুষের ধর্ম, ঈমান ও বিশ্বাসের সঙ্গে।

তাই পাহলভি শাসনের মধ্যবর্তী সময়ে তারা দ্বিতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করল। অবশ্য সেই তাগুত চলে গেল, আরেক তাগুত এলো; কিন্তু পর্দার আড়ালে ছিল অন্য শক্তি ও নীতি, যারা এই কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছিল। পিতা ও পুত্র—এরা কেবল কার্যকরী হাতিয়ার ছিল। দ্বিতীয় নীতিটি ছিল—হাওজা থাকবে, কিন্তু এমন হাওজা থাকবে যার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সম্পর্ক থাকবে না এবং যা বিশ্ববিদ্যালয় ও আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রতি অবিশ্বাসের ভিত্তিতে এগোবে। আর অন্যদিকে, প্রচার ও নানা পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে হাওজা, ধর্ম ও আলেমদের বিরোধী হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

বাস্তবে প্রচারযুদ্ধের মাধ্যমে ছাত্রসমাজ ও আধুনিক শিক্ষার পরিবেশে ধর্মীয় জ্ঞান ও আলেমদের ওপর প্রবল আক্রমণ চালানো হয়েছিল। আলেমদের এমন একদল বিরক্তিকর, ক্ষতিকর, অশিক্ষিত ও ওয়াক্‌ফ-সম্পত্তির পেছনে ছুটে বেড়ানো মানুষ হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছিল। কেন? যাতে পরিচ্ছন্ন, বিশ্বাসী, আন্তরিক তরুণ ছাত্রটি আদৌ কোনো আলেমের কাছে যেতে আগ্রহী না হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশে নানান ধরনের বিনোদন ও ব্যস্ততা সৃষ্টি করা হয়েছিল, যাতে তারা সব কিছুর প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে। এটাই ছিল তাদের পরিকল্পনা।

এর ফল কী হলো? ফল হলো—একটি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় এমন লোক তৈরি করল, যাদের জ্ঞান থেকে ইরানি জাতি ও দেশ কোনো উপকারই পেল না। আজ নতুন শিক্ষাব্যবস্থার সূচনা থেকে ষাট–সত্তর বছর পেরিয়ে গেছে। বিপ্লব-পরবর্তী কয়েক বছর ছাড়া—যখন ইরানি গবেষণার ওপর নির্ভরশীল একটি বাস্তব আন্দোলন শুরু হয়েছিল—এর আগে সত্যিকার অর্থে কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ হয়নি। রেজা খান ও তার পুত্রের আমলের বিশ্ববিদ্যালয় কোন বড় আবিষ্কার, কোন গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন, কোন

বিদেশনির্ভরতা ছিন্ন করেছে? বরং সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় দিন দিন দেশকে বিদেশের ওপর আরও নির্ভরশীল করে তুলেছিল।

এটি ছাত্রদের দোষ ছিল না। আমি প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য দিচ্ছি—সেই সময়ের ছাত্রদের কোনো দোষ ছিল না। এমন পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে মৌলিক বৈজ্ঞানিক কাজ সম্ভব ছিল না। পশ্চিমা সংস্কৃতি—বিশেষত আমেরিকাকে—এতটাই অতিমানবিক ও অধরা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল যে, আমাদের মুসলিম ছাত্ররা কল্পনাও করতে পারত না যে কেউ এই গভীর বৈজ্ঞানিক ব্যবধান অতিক্রম করতে পারে। ফলে কোনো প্রচেষ্টাও হতো না। সর্বোচ্চ বৈজ্ঞানিক সাফল্য বলতে বোঝানো হতো—পশ্চিমারা যা বানিয়েছে, তা ব্যবহার করতে পারা।

আমি বহুবার বলেছি—বিদেশে তৈরি কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি মেরামত করার অনুমতিও ইরানি প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের দেওয়া হতো না। এমনকি আধুনিক যুদ্ধবিমান বিক্রি করা হতো এই শর্তে যে, ইরানি প্রযুক্তিবিদরা এর কাছে যেতে পারবে না। নষ্ট হলে পুরো যন্ত্রাংশ খুলে বিদেশে পাঠানো হতো মেরামতের জন্য।

এমনকি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এমন অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল যে, ফারসি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ইরানি সাহিত্যিকদের চোখ থাকত—কোন বিদেশি কী বলেছে। আজও কেউ কেউ সেই পথেই চলতে চায়। আমরা যখন বলি—ইসলামী আইন পশ্চিমা আইনের চেয়ে সমৃদ্ধ—তখনও কেউ মানতে চায় না। শেখ আনসারির মতো মনীষীর গবেষণার পাশে কোন পশ্চিমা আইনবিদ দাঁড়াতে পারে? তবু আজও কেউ কেউ পশ্চিমা আইনের দিকেই তাকিয়ে থাকতে চায়।

এগুলো সেই সময়কার বিষাক্ত প্রভাবের ফল। এভাবেই তারা গড়ে তুলেছিল—হাওজার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে থাকা একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে পিঠ ঘুরিয়ে থাকা একটি হাওজা। বিশ্ববিদ্যালয়, যা হাওজার মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন; আর হাওজা, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে অজ্ঞ। হাওজা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐক্য মানে—এই দুইয়ের একে অপরের দিকে মুখ ফেরানো।

তারিখ: ২৭/৯/১৩৭৩ (ইরানি বর্ষপঞ্জি)

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha